হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও ফাঁদ বিষয়টি অনেকের জানা আবার অনেকের অজানা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হঠাৎ কিছু মেয়ের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেখতে পাবেন। অনেকে প্রোফাইল দেখে অ্যাড করেন, অনেকে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড দেখে অ্যাড করেন। আবার অনেকে কিছু না দেখেই অ্যাড করে থাকেন, মানে যুক্ত করে নেন। কিন্তু এই প্রোফাইল থেকে আপনি প্রতারিত হতে পারেন।
হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও ফাঁদে যেভাবে ফেলে
ফেসবুকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসার পর ওপাশ থেকে আপনাকে ‘হাই’ দেবে। তারপর সে বলবে তার অবস্থান মুম্বাই বা ভারতের কোনো শহরে। আপনি প্রোফাইলেও তার একাধিক ছবি স্ট্যাটাস থেকে সেটাই দেখতে পাবেন। তারপর দেখতে পাবেন আপনার পরিচিত অনেকেই তার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে। আপনিও কথা শুরু করবেন। একপর্যায়ে তিনি আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর চাইবেন। আপনিও দিয়ে দিলেন। তারপর ওপাশ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল আসবে। এবার আপনি কলটি ধরবেন আর ধরার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশে একটা অশ্লীল ভিডিও শুরু হবে। আপনি কিছু বোঝার চেষ্টা করতে করতেই সেটা সে রেকর্ড করে ফেলবে। এর পরপরই আপনাকে সেই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও রেকর্ড করা কলটি পাঠিয়ে একটা বিকাশ বা নগদ নম্বর পাঠিয়ে দেবে। আর এই টাকা না পাঠালে আপনার পরিচিত অনেকের কাছে এই ভিডিও পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি আসবে। আর এই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও ফাঁদে পড়ছেন দেশের অনেক মানুষ।
‘৫১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই’
কিছুদিন আগে এমনই এক বিপদে পড়েছিলেন একজন ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসলে আমি বুঝতে পারিনি। হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল আসে, আমি কলটি রিসিভ করি। রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একটি মেয়ে অশ্লীলভাবে বিভিন্ন ভঙ্গি করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি কলটি কেটে দিই। কিছুক্ষণ পরেই আমার কাছে এই ভিডিও রেকর্ডটি পাঠিয়ে দিয়ে টাকা দাবি করে। আমি মানসম্মানের ভয়ে তাদের বিভিন্ন সময়ে মোট ৫১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিই। এরপর আমি সাইবার ক্রাইমকে (বাংলাদেশ পুলিশের সাইবার অপরাধ দমন বিভাগ) জানাই। এরপর আমি এই চক্র থেকে বের হই। এটা আমার জীবনের একটি খারাপ অধ্যায়।’
এই বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী ও ফাইন্ড মাই অ্যাডভোকেটের প্রতিষ্ঠাতা মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হঠাৎ ভিডিও কল করে স্ক্রিনশট বা ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেল করছে। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। বর্তমানে একটি প্রতারক চক্র ভিডিও কল করে স্ক্রিনশট বা ভিডিও ধারণ করে মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তের অপব্যবহার করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করছে। এই চক্র ভিকটিমকে ব্ল্যাকমেল করে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার অপচেষ্টা চালায়। এ ধরনের কার্যকলাপ সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩ অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
আইনি প্রতিকার
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৪-এ আছে, যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশ ধারণ করে ভিডিও কল বা অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতারণা করেন, তবে তিনি এই ধারায় অভিযুক্ত হবেন।
ধারা ৩০-এ আছে, যদি প্রতারক ব্যক্তি অনলাইনে লেনদেন করে (যেমন বিকাশ, নগদ ইত্যাদি), তবে তিনি আর্থিক প্রতারণার দায়ে এই ধারায় অপরাধী হবেন। ধারা ২৫(ক) ও ২৯-এ আছে, যদি ভিকটিমের ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ বা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে এ দুটি ধারায় মামলা করা যাবে।
ভুক্তভোগীর করণীয়
* নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে। অভিযোগের সঙ্গে অবশ্যই ওই নম্বরটি বা সোশ্যাল আইডির লিংক, স্ক্রিনশট, ভিডিও ও লেনদেনের তথ্য সংযুক্ত করতে হবে।
* জিডির অনুলিপি থানার মাধ্যমে আদালতে পাঠাতে হবে। আদালত তদন্তের অনুমতি দিলে পুলিশ তদন্ত শুরু করতে পারবে।
* তদন্ত শেষে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব। প্রয়োজনে সাইবার অপরাধ দমন ইউনিটের সহায়তা নিন।
মনে রাখবেন, এমন পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে না গিয়ে আইনগত সাহায্য নিন। প্রতারক চক্রের ভয়ভীতি ও ব্ল্যাকমেলে প্রভাবিত না হয়ে সচেতন থাকুন এবং প্রমাণসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানান।
ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল আলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সব প্রতারণার ফাঁদে এমন মানুষ পড়েন, যাঁরা চক্ষুলজ্জায় আমাদের কাছে আসেন না। মানসম্মানের ভয়ে তাঁরা চুপ করে অপরাধীদের কথামতো টাকা পাঠিয়ে দেন। তাঁরা যদি ভয় না পেয়ে আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করেন, আমরা সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবস্থা নিতে পারি। কিন্তু দেখা গেছে, তাঁরা চুপচাপ অপরাধীদের কথামতো কাজ করে থাকেন। যার কারণে এই অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। আমি শুধু একটি কথা বলতে চাই, যদি কেউ এই হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও প্রতারণার ফাঁদে পড়েন, তাহলে ভয় না পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আপনার কাছের থানায় অভিযোগ করুন।’